বিআরটিএ দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে সমালোচিত। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এসব অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছেন পার্কন চৌধুরী—বর্তমানে বিআরটিএর রাজশাহী বিভাগের পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) এবং একইসঙ্গে রংপুর বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। তাঁর বিরুদ্ধে জরুরি লাইসেন্স ইস্যুতে ঘুষ বাণিজ্য, বিদেশগামী সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে অর্থ আদায়, বিল–ভাউচার সিন্ডিকেট, প্রশিক্ষণ বাজেট আত্মসাৎ ও অডিট রিপোর্ট ‘ম্যানেজ’ করার মতো একের পর এক অভিযোগ উঠলেও আজ পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
বিআরটিএর ভেতরে–বাইরে এখন আলোচনার কেন্দ্রে একটাই প্রশ্ন—এত অভিযোগের পরও কীভাবে পার্কন চৌধুরী বহাল তবিয়তে আছেন?
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, পার্কন চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ শুধু ব্যক্তিগত দুর্নীতিতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এগুলো বিআরটিএর ভেতরে গড়ে ওঠা এক ধরনের শক্তিশালী ‘ম্যানেজমেন্ট-নির্ভর সংস্কৃতি’র প্রতিফলন। সূত্রমতে, প্রশাসনিক ও প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ এবং উপরমহল “ম্যানেজ” করার সক্ষমতাই এখন তাঁর সবচেয়ে বড় শক্তি—যে কারণে অভিযোগ জমা পড়লেও সেগুলো আর তদন্ত কিংবা শাস্তির পর্যায়ে পৌঁছায় না।
বিদেশগামী সেবাগ্রহীতাদের জন্য জরুরি লাইসেন্স প্রদানের নামে রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ে একটি গোপন সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী সরাসরি দপ্তরে আবেদন করার কথা থাকলেও, বাস্তবে আবেদন প্রক্রিয়া জটিল করে ফেলা হয়। এরপর নির্ধারিত টাকার বাইরে অতিরিক্ত অর্থ প্রদান না করলে মাসের পর মাস ফাইল আটকে রাখা হয়। সূত্র জানায়, হিসাব রক্ষক মোহাম্মদ আলির মাধ্যমে এই অর্থনৈতিক লেনদেন শেষ পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়। নির্ধারিত পথে না চললে আবেদন ‘ফ্রিজ’ হয়ে যায়—এমন অভিযোগ করছেন ভুক্তভোগীরা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত ২০২৩ সালের (৬ ফেব্রুয়ারি) চলতি বছরের ১৭ এপ্রিল পযর্ন্ত পার্কন চৌধুরী ঢাকা মেট্রো–৪–এর উপপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই দুই বছরের বেশি সময়ের মধ্যে প্রশিক্ষণ খাতে বরাদ্দ ছিল আড়াই থেকে তিন কোটি টাকা, যা তিনি তাঁর নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে পরিচালনা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
সূত্র জানায়, এই খাতে দুর্নীতির কয়েকটি চিহ্নিত প্রক্রিয়া ছিল—অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়িয়ে দেখানো: প্রকৃত প্রশিক্ষণ অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা কম হলেও ভাউচারে সংখ্যা বাড়িয়ে দেখানো হয়, যাতে বাজেট অনুযায়ী বড় অঙ্কের অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে।
ডুপ্লিকেট ভাউচার ও ভ্রমণ খরচ: একই খরচের ডুপ্লিকেট বা পুরনো রসিদ ব্যবহার করে সরকারি অর্থ উত্তোলন করা হতো।
‘টোকেন ট্রেনিং’ দেখানো: যে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বাস্তবে হয়নি, তা সম্পন্ন হয়েছে বলে দেখানো হতো।
কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপটি হলো—যখন এই অনিয়ম ফাঁস হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি করে, তখন পার্কন চৌধুরী তাঁর শক্তিশালী নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে বিষয়টি ধামাচাপা দিতে সক্ষম হয়ে আসছেন
ঢাকা মেট্রো–৪ সূত্র বলছে, অডিট রিপোর্টে যেসব অনিয়ম ধরা পড়ে, সেগুলোও প্রভাবশালীভাবে ম্যানেজ করে রিপোর্ট ‘চুপ’ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সেক্টরের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের ওপর প্রভাব প্রয়োগ করে কোনো অনুসন্ধান বা শাস্তিমূলক পদক্ষেপকে বাতিল বা স্থগিত রাখা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা বলেন,“যখন বাজেটের আত্মসাৎ ফাঁস হওয়ার উপক্রম হয়, তখন তিনি অডিট অফিস এবং সেক্টরের বিভিন্ন স্তরে ম্যানেজমেন্ট করে বিষয়টি ধামাচাপা দেন। পার্কন চৌধুরী তার ক্ষমতা প্রয়োগ করে সব ফাইলও ‘সাফ’ করা হয়। এটা একেকটি কৌশল, যা শুধু উনার শক্তিশালী নেটওয়ার্কের কারণে সম্ভব।”
অভ্যন্তরীণ সূত্র জানায়, এই নেটওয়ার্ক কেবল ফাঁস ঠেকানোই নয়, বরং অনিয়ম চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় ছাতা হিসেবে কাজ করে। ফলে, ঢাকা মেট্রো–৪–এর সময়ের অভিজ্ঞতা পার্কন চৌধুরী রাজশাহী ও রংপুরে স্থানান্তরিত হয়ে আরও বড় আকারে পুনরাবৃত্তি করেছে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন—এখনও পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, কারণ তিনি কেবল ব্যক্তি নয়; তাঁর শক্তিশালী নেটওয়ার্ক এবং হিসাব রক্ষকের সহযোগিতা তাঁকে বহাল তবিয়তে রাখছে। এবং এই নেটওয়ার্কই বিআরটিএর ভেতরে ভয়, নীরবতা ও অনিয়মের সংস্কৃতিকে স্থায়ী করেছে।
আরেক কর্মকর্তা বলেন,“প্রশিক্ষণ খাতে যত বড় বাজেট আসতো, সেই অনুযায়ী ‘ম্যানেজ’ করা হতো। পার্কন চৌধুরীর নেটওয়ার্কের সহযোগিতা ছাড়া এটা সম্ভব না।”
সূত্রগুলো স্পষ্ট করে বলছে—ঢাকা মেট্রো–৪–এর দায়িত্বকালীন এ ধরণের দুর্নীতি শুধুমাত্র অর্থ লেনদেন নয়, বরং ভেতরের নেটওয়ার্ক ব্যবস্থাপনার একটি স্বচ্ছ ও সুসংগঠিত কৌশল। এই অভিজ্ঞতা পার্কন চৌধুরী রাজশাহী ও রংপুরে স্থানান্তরিত হয়ে আরও বড় আকারে চালু করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
রংপুর সার্কেলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ বলে জানিয়েছেন একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী। তাঁদের ভাষ্য অনুযায়ী, পরিদর্শন টুর মানেই আতঙ্ক। কারণ, টুরের আগেই কে কত টাকা দেবে তা নির্ধারিত থাকে। নথি বা অনিয়ম অনুসন্ধান নয়, বরং টাকা আদায়ই মূল উদ্দেশ্য—এমন অভিযোগ করেছেন তাঁরা। ফাইল আটকে রেখে চাপ সৃষ্টি করা হয়, যেন নির্ধারিত অর্থ আদায়ে কোনো ব্যত্যয় না ঘটে। ভয়, বদলি ও প্রশাসনিক হয়রানির আশঙ্কায় কেউ প্রকাশ্যে কথা বলতে প্রস্তুত নন।
রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ে পার্কন চৌধুরী ও হিসাব রক্ষক মোহাম্মদ আলিকে ঘিরে একটি বিল–ভাউচার সিন্ডিকেট পরিচালনার অভিযোগও উঠেছে। অভিযোগ অনুযায়ী, বাস্তবে কোনো কাজ না করে বিল উত্তোলন, একই প্রকল্পে একাধিকবার বাজেট দেখানো, অফিস মেরামত, ভাড়া ও স্টেশনারির নামে ভুয়া ও ওভাররেট ভাউচার তৈরি করে সরকারি অর্থ উত্তোলন করা হচ্ছে। একাধিক কর্মকর্তা দাবি করেছেন, এসব ভাউচারে সংশ্লিষ্ট দু’জন ছাড়া অন্য কেউ হাত দেওয়ার সাহস করেন না।
বিআরটিএর সূত্র বলছে, মোহাম্মদ আলি হয়ে উঠেছেন এমন একজন ব্যক্তি, যাঁকে পাশ কাটিয়ে কেউ কাজ করতে সাহস পান না। ফলে তিনি পার্কন চৌধুরীর শক্তিশালী নেটওয়ার্কের অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়েছেন।
এত অভিযোগ, অডিটের প্রশ্ন এবং ভেতরের প্রতিবাদের পরও পার্কন চৌধুরীর বিরুদ্ধে কোনো তদন্ত কমিটি গঠন হয়নি। দুর্নীতি দমন কমিশনে কোনো রেফারেন্স যায়নি। বরং তিনি বহাল তবিয়তেই দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন, যা নিয়ে বিআরটিএর ভেতরেই তীব্র ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, এটি কেবল একজন কর্মকর্তার দুর্নীতির প্রশ্ন নয়; বরং সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের নীরবতা পুরো প্রতিষ্ঠানকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, যাঁরা অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলার চেষ্টা করেছেন, তাঁদের বদলি, শোকজ ও মানসিক চাপে রাখা হয়েছে। ফলে বিআরটিএতে এখন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলাই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এক কর্মকর্তা বলেন, “এখানে বার্তা পরিষ্কার—ম্যানেজ করতে জানলে কিছুই হবে না।”
সব মিলিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়—এত অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও পার্কন চৌধুরী কীভাবে বহাল থাকেন? কারা তাঁকে রক্ষা করছে? আর এই নীরবতার মূল্য কি দিতে হচ্ছে না সাধারণ সেবাগ্রহীতা ও সরকারের স্বচ্ছতাকে?
বিআরটিএর অভ্যন্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, রাজশাহী ও রংপুর সার্কেল থেকে অর্থ আদায়ের অভিযোগ বন্ধ করা, বিল–ভাউচার সিন্ডিকেট ভাঙা, ঢাকার পুরোনো অডিট রিপোর্ট পুনর্মূল্যায়ন এবং অভিযোগকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করা গেলে এই দুর্নীতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
বিআরটিএর রাজশাহী বিভাগের পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) পার্কন চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিন অস্বীকার করে বলেন,অনিয়ম দূর্নীতির যে সকল অভিযোগ গুলো আমার বিরুদ্ধে উঠেছে সেগুলো পুরোপুরি মিথ্যা ও বানোয়াট বলে
জানতে চাইলে হিসাব রক্ষক মোহাম্মদ আলি বলেন, আপনি অফিসে আসুন সরাসরি সাক্ষাৎ করে কথা বলবো। প্রতিবেদক আবারও মোহাম্মদ আলিকে বিল–ভাউচার সিন্ডিকেট পরিচালনার অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি আরো বলেন, পার্কন স্যার অফিসে আছেন আপনি স্যারের সাথে কথা বলুন অফিসের নিয়মের বাইরে কোন কিছু বলতে পারবোনা।

